করোনাভাইরাস: ঈদের কেনাকাটায় 'লকডাউনের' প্রভাব, কী ভাবছেন বিক্রেতারা?

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশে চলমান ছুটির কারণে গত প্রায় দেড় মাস যাবত বন্ধ রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া আর সব ধরণের দোকানপাট। যার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে সব ধরণের পোশাকের দোকান।
আর রোজার ঈদের আগে সারাদেশে সব ধরণের পোশাকের দোকানগুলো বন্ধ থাকায় দেশীয় ফ্যাশন হাউজ এবং তৈরি পোশাক বিক্রি করা দোকানগুলো বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়বে।
সারা দেশে সব ধরণের শপিং মল, বাজার এবং দোকানপাট বন্ধ থাকায় কিছু ফ্যাশন হাউজ এবং দোকান ক্রেতাদের কাছে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করা শুরু করলেও তার পরিধি চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত কম বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬শে মার্চ থেকে বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর ছয় দফা বাড়িয়ে ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয় ১৪ই মে পর্যন্ত। আর এই সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব ধরণের দোকান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
পোশাকের দোকান বন্ধ থাকার ফলে পহেলা বৈশাখে (১৪ই এপ্রিল) পণ্য বিক্রি করতে পারেনি ফ্যাশন হাউজগুলো, যার ফলে ঐ দফায় বড় অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হয় তারা।
এবার রোজার ঈদের আগে দিয়ে সেসব ফ্যাশন হাউজ এবং পোশাকের দোকানগুলোর কার্যক্রম শুরু না হলে দেশীয় পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত লাখ লাখ মানুষের জীবন তো বটেই, পুরো শিল্পই হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংকটে দেশের লক্ষাধিক পোশাকের দোকান

ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে একটি তৈরি পোশাকের দোকান রয়েছে জাবেদ আক্তারের। তিনি দোকানে মূলত নারীদের পোশাকই বিক্রি করে থাকেন।
জাবেদ আক্তার বলেন বছরের দশ-এগারো মাস ব্যবসায় ক্ষতি হলেও রমজান মাসে সারাবছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে তাদের কাছে, যেটি এই বছর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
"ঈদকে সামনে রেখে ঋণ করে কিছু টাকা অগ্রীম দিয়ে নানা ধরণের পণ্য তুলেছি দোকানে। ঈদে বিক্রির টাকা পাওয়ার পর সেই টাকা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু দোকান বন্ধ থাকার কারণে বিক্রি না হওয়ায় ঋণও শোধ করতে পারবো না, পণ্যের দামও দিতে পারবো না।"



বাংলাদেশে মানুষ সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা করে থাকে রোজার ঈদের সময়ছবির কপিরাইটGETTY IMAGES
Image captionবাংলাদেশে মানুষ সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা করে থাকে রোজার ঈদের সময়

আর এই ক্ষতির রেশ আগামী অন্তত এক বছর ধরে তাকে টানতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন জাবেদ আক্তার।
জাবেদ আক্তারের মত হাজার হাজার দোকান মালিক এই সমস্যায় পড়বে বলে মনে করেন আসাদ ইফতেখার নামে এক দোকান মালিক, যিনি চট্টগ্রামের দুইটি শপিং মলের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি।
আসাদ ইফতেখার বলেন, "বৈশাখ এবং ঈদকে মাথায় রেখে অধিকাংশ দোকান পাঁচ ছয় মাস আগে থেকেই বিভিন্ন পণ্য কিনেছে এবং অর্ডার দিয়েছে। এসব পণ্য কেনার ক্ষেত্রে দোকানদাররা সাধারণত ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন মেয়াদে ঋণ করে, তারপর ক্রেতাদের আংশিক মূল্য পরিশোধ করে পণ্য কেনে এবং উৎসবের সময় তা বিক্রি করে পরে ঋণ এবং মূল্য পরিশোধ করে থাকে।"


কিন্তু ঈদের সময় যেই পরিমাণ বিক্রি হওয়ার কথা, এবছর তা না হওয়ায় দোকানদাররা অর্থ পরিশোধ করতে পারবেন না, যার প্রভাব পড়বে ঈদ পরবর্তী ব্যবসায়িক কার্যক্রমে।
অনেক দোকানদারই ঈদের জন্য তৈরি করা পণ্য - যেমন চামড়াজাত পণ্য - নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে পরে বিক্রি করতে পারবে না। আবার অনেক পোশাকও ঈদের পরে বিক্রি হবে না।"
"এই দোকানদারদের অনেকে তাদের পুরনো ঋণ শোধ না করে নতুন ঋণ নিতে সমস্যায় পড়বে। ফলে ঈদের পরে নতুন করে কার্যক্রম চালাতে পারবে না তারা। এর প্রভাবে ছোট আকারের অনেক দোকানদারই দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে না বলে আশঙ্কা করছি আমরা।"
আবার দোকানদাররা যেখান থেকে কাঁচামাল কেনে, সেসব প্রতিষ্ঠানের মূল্য পরিশোধ করতে না পারার কারণে দীর্ঘমেয়াদে সেসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোর ব্যবসায় টিকে থাকতে সমস্যা হতে পারে বলে মন্তব্য করেন আসাদ ইফতেখার।



বাংলাদেশের ফ্যাশন খাতের উদ্যোক্তাদের সংস্থার হিসেব অনুযয়ী এবারের ঈদে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে তাদেরছবির কপিরাইটGETTY IMAGES
Image captionবাংলাদেশের ফ্যাশন খাতের উদ্যোক্তাদের সংস্থার হিসেব অনুযয়ী এবারের ঈদে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে তাদের

ঝুঁকিতে ক্ষুদ্রশিল্পের সাথে জড়িতরা

দোকানপাট বন্ধ থাকায় তৈরি পোশাক বিক্রি করা দোকান মালিকদের পাশাপাশি বিপদে পড়েছেন ফ্যাশন শিল্প খাতের বড়-ছোট উদ্যোক্তারাও।
দেশি উদ্যোক্তাদের সবাই গত প্রায় দেড় মাস ধরে তাদের বিক্রয় কেন্দ্র বন্ধ রাখায় এই উদ্যোক্তাদের সাথে কাজ করা ক্ষুদ্রশিল্প, কুটির শিল্প ও দেশজ বুননশিল্পের সাথে জড়িত লক্ষাধিক শ্রমিক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশের ফ্যাশনশিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন ফ্যাশন অন্ট্রাপ্রনার্স অব বাংলাদেশের সভাপতি শাহীন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে জানান তাদের আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী সারা দেশে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া শ্রমিকদের এই সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখের কাছাকাছি।
শাহীন আহমেদও আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে ফ্যাশন হাউজগুলোর সাথে কাজ করা শ্রমিকদের অনেকেই এই খাত থেকে সরে গিয়ে অন্য খাতে কাজ করতে বাধ্য হতে পারেন।
"বড় ফ্যাশন হাউজগুলো যখন তাদের জন্য পণ্য তৈরি করা তাঁতী বা শ্রমিককে পুরো মূল্য পরিশোধ করতে পারবে না, তখন তাদের কাজও থমকে যাবে। কারণ অধিকাংশ সময় তারাও মাঝারি বা ক্ষুদ্র পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ নিয়ে বড় হাউজগুলোর জন্য পণ্য তৈরি করে।"
"সেই শ্রমিকরা যখন তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না, তাদের অনেকেই অন্য খাতে কাজ করে ঋণ শোধ করতে চাইবে। ফলে তারা কাজ পরিবর্তন করে অন্য খাতে শ্রম দেবে, যা পণ্যের গুণগত মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে," বলেন শাহীন আহমেদ।
Reactions

Post a Comment

0 Comments