করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জারি করা লকডাউন বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ থেকেই ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হচ্ছে।
এর পেছনে একটা কারণ: দেশগুলোর অর্থনীতি যাতে আবার স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে। অর্থাৎ লকডাউন ও বিধি-নিষেধের কারণে স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতি যাতে পুনরায় সচল হয়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ ধারণা করছে যে এসব লকডাউনের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি এবছর তিন শতাংশ সংকুচিত হবে। কিন্তু এর আগে তারা ঠিক পুরো উল্টো ধারণা করে বলেছিল যে এবছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে তিন শতাংশ।বলা হচ্ছে, ঊনিশশো তিরিশের দশকে যে বিশ্ব মহামন্দা পরিস্থিতি (যা গ্রেট ডিপ্রেশন নামে পরিচিত) তৈরি হয়েছিল, তার পর এই প্রথম করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার বড় রকমের ধ্বস নেমেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিস্থিতি কতদিন স্থায়ী হবে এবং বিশ্ব অর্থনীতি এই মন্দা পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বের হয়ে আসবে?
মন্দার সংজ্ঞা
পর পর দুটো ত্রৈমাসিক পর্বে (অর্থনৈতিক অভিধানে যাকে কোয়ার্টার বলা হয়। পুরো বছরকে ভাগ করা হয় মোট চারটি কোয়ার্টারে। একেকটি কোয়ার্টারে থাকে তিন মাস সময় ) মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি যদি কমে যায় তবে অনেক দেশই তাকে মন্দা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চ বলছে, মন্দা হচ্ছে যখন সর্বক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায় এবং সেটা কয়েক মাসেরও বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয়। সাধারণত এটা প্রকৃত জিডিপি, প্রকৃত আয়, কর্মসংস্থান, শিল্প উৎপাদন এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রির মধ্যে প্রতিফলিত হয়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ বলছে, অর্থনীতিতে কোভিড-নাইনটিনের সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে ২০২০ সালের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে অর্থাৎ এপ্রিল, মে ও জুন এই তিন মাসে।
তবে এটাও আশা করা হচ্ছে যে এবছরের দ্বিতীয়ভাগে গিয়ে যখন দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হবে তখন মন্দা পরিস্থিতি কেটে যেতে শুরু করবে।
কিন্তু বছরের দ্বিতীয়ভাগে অর্থাৎ জুন মাসের পরেও যদি লকডাউনের মতো বিধি-নিষেধ বহাল থাকে তাহলে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে এবং তার ফলে বহু মানুষ তাদের চাকরি হারাবে।
যদি এরকম কিছু হয় তাহলে মন্দা আরো অনেক বেশি গভীর হবে এবং তা থেকে বেরিয়ে আসতেও অনেক সময় লাগবে।
ফলে আমরা চার ধরনের মন্দা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি। এসব পরিস্থিতি চারটি ইংরেজি অক্ষর V, U, W অথবা L এর মতো আকার নিতে পারে।
অর্থনৈতিক মন্দা ও তা থেকে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদরা এই চারটি অক্ষর ব্যবহার করে থাকেন।
ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অফ চিলির একজন অর্থনীতিবিদ জোসে টেসাডা বিবিসিকে বলেছেন, “জিডিপির প্রবৃদ্ধির গ্রাফের যে আকার তার মধ্যে এই অক্ষরগুলো প্রতিফলিত হয়।”
আদর্শ যা হতে পারে: V
এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল বা আদর্শ যা হতে পারে তা হলো খুব দ্রুত অর্থনীতি পড়ে যাওয়ার পর সেটা আবার সাথে সাথেই খুব দ্রুত উপরের দিকে উঠে যাওয়া। এটা দেখতে ইংরেজি V অক্ষরের মতো।
“এই রকম হলে যেটা হয় তা হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। এক্ষেত্রে মন্দাভাব তুলনামূলকভাবে কম সময় স্থায়ী হয়, যদিও এই পরিস্থিতি কয়েকটি ত্রৈমাসিক পর্ব বা কোয়ার্টার ধরে চলতে পারে,” বলেন প্রফেসর টেসাডা।
“আমরা যদি মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে যে মন্দা দেখবো সেটা হতে পারে V অক্ষরের মতো। কারণ এর ফলে বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া হবে এবং তার পর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যাওয়া যেতে পারে।”
নিউ ইয়র্কে গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসএন্ডপি গ্লোবাল রেটিংস এর প্রধান অর্থনীতিবিদ পল গ্রোনভাল্ড বিবিসিকে বলেছেন: “সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেগুলো যদি খুব দ্রুত তুলে নেওয়া হয় অথবা কোভিড-নাইনটিন রোগের কোন টিকা বা চিকিৎসা আবিষ্কার হয় তাহলে আমরা খুব দ্রুত আমাদের আগের পথে ফিরে যেতে পারবো।”
এসএন্ডপির আশঙ্কা ২০২০ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক পর্বে অর্থাৎ এপ্রিল, মে ও জুন এই তিন মাস সময়ে অর্থনীতি নয় শতাংশ সংকুচিত হবে। এই ক্ষেত্রে মি. গ্রোনভাল্ড খুব একটা আশাবাদী নন যে অর্থনীতিতে খুব দ্রুতই পুনরুদ্ধার ঘটবে।
সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা : U
এসএন্ডপি ধারণা করছে ২০২০ সালে অর্থনীতি ২.৪ শতাংশ হ্রাস পাবে কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ৫.৯ শতাংশ ।
মি. গ্রোনভাল্ড বলছেন, “এখন আমরা যে অবস্থা দেখতে পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে এই পুনরুদ্ধারের বিষয়টি U অক্ষরের মতো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অথবা এই U হয়তো আরো একটু বিস্তৃত হতে পারে। এর অর্থ হলো বেশিরভাগ ক্ষতিই আমরা কাটিয়ে উঠবো তবে তার গতি হবে ধীর, ফলে একটু সময় লাগবে।”
এই অনুমানের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন নিউ ইয়র্কে অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মুডির ইনভেস্টরস সার্ভিসের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক এলেনা ডাগার।
মুডির সর্বশেষ অর্থনৈতিক পূর্বাভাস হচ্ছে – করোনাভাইরাসের ক্ষত ২০২১ সালের অর্থনীতি জুড়েও রয়ে যাবে।
“এবছরের দ্বিতীয় ভাগে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ঘটবে না। কারণ বছরের প্রথম ভাগে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকবে,” বিবিসিকে একথা বলেছেন মিস ডাগার।
তবে তিনি চীন থেকে আসা কিছু ‘ইতিবাচক সংবাদ’ দেখতে পাচ্ছেন যেখানে দেখা যাচ্ছে যে ত্রৈমাসিক একটি পর্বের আগেই সেখানে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার শুরু হয়ে গেছে।
“আমরা দেখছি যে চীনে লকডাউন তুলে নেওয়া হচ্ছে, কল কারখানা আবার খুলে দেওয়া হচ্ছে। একেক শিল্পে দেখা গেছে যে কোথাও ৪৫ শতাংশ আবার কোথাও ৭০ শতাংশ পুনরুদ্ধার হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।”
আরেকটি বিষয় হচ্ছে অর্থনীতিকে সহযোগিতা করতে সরকার খুব দ্রুত সক্রিয় হয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
“আমাদের বিশ্বাস বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ার পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরায় শুরু হলে এবছরের দ্বিতীয় ভাগে অর্থনীতির কিছু পুনরুদ্ধার ঘটবে,“ বলেন মিস ডাগার।
পুনরুদ্ধারের কঠিন পথ: W
কোভিড-নাইনটিন প্রতিরোধে এখনও কোন টিকা বা এর কোন চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি যার ফলে আমাদের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, বলেন মি. গ্রোনভাল্ড।
সরকারগুলো এখন বিধি-নিষেধ শিথিল করতে পারে যার ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার শুরু হবে। তবে যদি দ্বিতীয় দফায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে শুরু করে তখন পুনরায় লকডাউন কঠোর হতে পারে যার ধাক্কা আবার গিয়ে লাগতে পারে অর্থনীতিতে।
এক্ষেত্রে অর্থনীতিতে দুবার পতন ঘটতে পারে বা মন্দা দেখা দিতে পারে যা দেখতে ইংরেজি W অক্ষরের মতো, বলেন প্রফেসর টেসাডা।
“একবার ছেদ ঘটার পর চূড়ান্তভাবে পুনরুদ্ধারের ঘটনা ঘটবে। প্রথম দফায় অর্থনীতি মন্দা পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসবে ঠিকই কিন্তু সেটা স্থায়ী হবে না। এর পর আবারও পতন ঘটবে।”
“আমরা যদি আবারও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থায় ফিরে যাই তাহলে অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে দীর্ঘ সময় লাগবে,” বলেন মি. গ্রোনভাল্ড।
এক ‘নতুন স্বাভাবিক‘ অবস্থা : L
অনেকেই বলছেন করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে “এক নতুন স্বাভাবিক” অবস্থা তৈরি হতে পারে কীনা।
এই পরিস্থিতি ইংরেজি অক্ষর L আকৃতির। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে দ্রুত ও বড় ধরনের পতনের পর পুনরুদ্ধার ঘটে কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে যায় কম মাত্রায়।
“এটা মন্দার চাইতেও বেশি, এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির মাত্রায় স্থায়ীভাবে পরিবর্তন ঘটবে,” বলেন প্রফেসর টেসাডা।
এসএন্ডপি সতর্ক করে দিয়েছে করোনাভাইরাসের টিকা কিম্বা চিকিৎসা বের না হলে অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হবে।
এরকম ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া হতে পারে “অসম্ভব”।
তবে যাই হোক না কেন মি. গ্রোনভাল্ড বলছেন, প্রশ্ন হচ্ছে আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবো কীনা।
0 Comments